Kumartuli: দুর্গাপুজো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। কলকাতার কুমোরটুলি যেন সেই উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। প্রতিমার আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত এই এলাকা প্রতিবছর হাজার হাজার প্রতিমা তৈরি করে শহর কলকাতা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠায়। কিন্তু ২০২৫ সালের পুজোর আগেই সেখানে নেমে এসেছে এক নতুন বিপদ।
কলকাতা পুলিশের কড়া নির্দেশ – প্রতিমা তৈরিতে কোনওভাবেই থার্মোকল বা থার্মোকলের তৈরি দ্রব্য (যেমন চুমকি, অলঙ্কার ইত্যাদি) ব্যবহার করা যাবে না। পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে নেওয়া এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিমা শিল্পীরা (Kumartuli)। তাঁদের দাবি, পুজোর মাত্র একমাস আগে এ ধরনের নির্দেশ তাঁদের মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা তৈরি করেছে।
কুমোরটুলিতে (Kumartuli) কেন থার্মোকল নিষিদ্ধ?
থার্মোকল বহু বছর ধরেই প্রতিমা সাজসজ্জার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। হালকা, টেকসই এবং খরচে কম হওয়ায় শিল্পীরা সহজেই এটি দিয়ে প্রতিমার অলঙ্করণ করতেন। কিন্তু এর বড় সমস্যা হলো –
- থার্মোকল অজৈব পদার্থ, ফলে জলে বা মাটিতে গিয়েও তা নষ্ট হয় না।
- বিসর্জনের পর নদীতে ভেসে যাওয়া থার্মোকল গঙ্গা ও অন্যান্য জলাশয়ের জলে মারাত্মক দূষণ তৈরি করে।
- মাছ ও জলজ প্রাণীরা থার্মোকল খেয়ে ফেললে মারা পড়ে।
- প্লাস্টিক দূষণের মতোই থার্মোকলও দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ সংকটের কারণ।
পরিবেশবিদদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে এবার পুলিশ কড়া পদক্ষেপ নিল। কিন্তু শিল্পীদের অভিযোগ, সময়ের আগে বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া এমন ফরমান চাপিয়ে দেওয়া একেবারেই অন্যায্য।
প্রতিমা শিল্পীদের ক্ষোভ
পুজোর আগে প্রতিমা শিল্পীরা সর্বাধিক ব্যস্ত থাকেন। প্রায় প্রতিটি কারখানাতেই কাজ চলছে রাতদিন। এর মধ্যেই পুলিশের হঠাৎ হানা ও নির্দেশে তাঁদের মাথায় হাত।
- বিনিয়োগের ক্ষতি: শিল্পীদের দাবি, তাঁরা ইতিমধ্যেই প্রতিমা তৈরির জন্য লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। অনেকেই প্রচুর থার্মোকল কিনে ফেলেছেন। এখন হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা মানে সেই টাকা পুরো ক্ষতি।
- বিকল্প নেই: প্রতিমার সজ্জায় থার্মোকলের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব কিছু ব্যবহার করা সম্ভব হলেও তা পেতে ও প্রয়োগ করতে সময় লাগে। পুজোর মাত্র ৪০ দিন আগে সেটা সম্ভব নয়।
- আত্মহত্যার হুমকি: একাধিক শিল্পী ক্ষোভে বলেছেন, “এভাবে কাজ বন্ধ করলে পরিবার নিয়ে না খেতে পেয়ে আত্মহত্যা করতে হবে।”
- পুলিশি জুলুম: অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ সরাসরি কুমোরটুলির দোকানে গিয়ে হুমকি দিচ্ছে, যেন থার্মোকল ব্যবহার না করা হয়।
পুজো কমিটিগুলির দুশ্চিন্তা
শুধু শিল্পীরাই নয়, কলকাতার বিভিন্ন দুর্গাপুজো কমিটিও চিন্তায় পড়েছে।
- মণ্ডপের বাজেট ও সজ্জার বড় অংশ নির্ভর করে থার্মোকলের উপর।
- হঠাৎ করে বিকল্প ডিজাইন ও সামগ্রী আনার সময় নেই।
- প্রতিমার কাজ থমকে গেলে সময়মতো ডেলিভারি না-ও হতে পারে। ফলে বড় বড় পুজো কমিটির পক্ষ থেকেও সরকারের কাছে বিকল্প পরিকল্পনার দাবি উঠতে পারে।
পরিবেশবিদদের বক্তব্য
অন্যদিকে পরিবেশ কর্মীরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত একেবারেই সঠিক।
- প্রতিবার বিসর্জনের পর গঙ্গার জলে যে ভয়াবহ দূষণ হয়, তার অন্যতম কারণ থার্মোকল।
- বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব উপাদান দিয়ে প্রতিমা তৈরির প্রবণতা বাড়ছে।
- মাটি, কাপড়, পাট, কাঠ, বাঁশের মতো জৈব পদার্থ ব্যবহার করলে নদী বা পরিবেশের কোনও ক্ষতি হয় না।
তাঁদের মতে, এখনই যদি এই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
কুমোরটুলির ভবিষ্যৎ কি বিপন্ন?
প্রতিমা শিল্পীদের অভিযোগ, সরকারের উচিত ছিল এক বছর আগে এই নিয়ম কার্যকর করা। তাহলে সময় নিয়ে বিকল্প ভাবা যেত। অনেকের মতে, হঠাৎ করে কড়াকড়ি করা হলে কুমোরটুলির ওপর এর বড়সড় প্রভাব পড়বে।
- অনেক শিল্পী পেশা ছাড়তে বাধ্য হবেন।
- বড় মাপের প্রতিমা অর্ডার কমে যেতে পারে।
- কলকাতা ছেড়ে অন্য জায়গা থেকে প্রতিমা আমদানি হতে পারে।
সম্ভাব্য বিকল্প কী হতে পারে?
যদিও সময় কম, তবু কিছু বিকল্প নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে:
- পাটের তৈরি অলঙ্কার – একে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই বলা হয়।
- কাপড় ও কাগজ – রঙিন কাগজ বা কাপড় দিয়ে ডিজাইন করা সম্ভব।
- মাটির ক্ষুদ্র নকশা – একটু সময়সাপেক্ষ হলেও টেকসই।
- বাঁশ ও কাঠের ফ্রেম – ঐতিহ্যবাহী উপায়ে প্রতিমা সাজানোর একটি মাধ্যম।
তবে শিল্পীদের বক্তব্য, এগুলি ব্যবহার করতে গেলে সময়, প্রশিক্ষণ ও বাড়তি খরচ – সবই প্রয়োজন।
সমাজের প্রতিক্রিয়া
সমাজের বিদ্বজনেরা এই পদক্ষেপ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত।
- একদল বলছেন, পরিবেশ রক্ষার জন্য এর বিকল্প নেই।
- অন্যদল মনে করছেন, সময়মতো পরিকল্পনা না করে শিল্পীদের বিপদে ফেলা ঠিক হয়নি। অনেকে আবার দাবি তুলেছেন, “পুজো কমিটি, সরকার ও শিল্পীরা একসাথে বসে বিকল্প সমাধান খুঁজে বের করা উচিত।”
দেবী দুর্গার আগমন বাঙালির ঘরে ঘরে আনন্দের বার্তা আনে। কিন্তু সেই আনন্দের মাঝেই কুমোরটুলির (Kumartuli) শিল্পীদের চোখে জল। পুলিশের হঠাৎ থার্মোকল নিষিদ্ধের ফরমান তাঁদের সামনে বড়সড় অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। যদিও পরিবেশ রক্ষার যুক্তি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, তবুও শিল্পীদের মতে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত পূর্ব পরিকল্পনা ও বিকল্প সহকারে বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। না হলে প্রতিমা শিল্প, পুজো কমিটি এবং সাধারণ মানুষের উৎসবের আনন্দ সবই ব্যাহত হবে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান কীভাবে হয় – কুমোরটুলির শিল্পীরা কি পরিবেশবান্ধব বিকল্প খুঁজে পান, নাকি পুজোর আগে বড়সড় অস্থিরতা তৈরি হয়?
অবশ্যই দেখবেন: হাসপাতালের বেডে শুয়ে হঠাৎ বার্তা! এখন কেমন আছেন দেবাংশু? জানুন তাঁর মুখে