শুক্রবার দুপুরে যে খবরটি এল, তা শুধু অসম বা উত্তর-পূর্ব ভারত নয়, গোটা দেশকেই স্তব্ধ করে দিল। বলিউড ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গীত জগতের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র জুবিন গর্গ (Zubeen Garg) আর নেই। সিঙ্গাপুরে স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়েই ঘটে যায় এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ‘চতুর্থ নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া ফেস্টিভ্যাল’-এ পারফর্ম করতে তিনি সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানের আনন্দের মাঝেই ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
কীভাবে ঘটল এই দুর্ঘটনা?
উৎসবের পক্ষ থেকে অনুজ কুমার বোরুয়া জানিয়েছেন, ডাইভিং করার সময় হঠাৎ শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন জুবিন গর্গ (Zubeen Garg)। দ্রুত তাঁকে জলের ভেতর থেকে উদ্ধার করে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা সঙ্গে সঙ্গে সিপিআর দেন, নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ভারতীয় সময় দুপুর আড়াইটে নাগাদ আইসিইউতে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। সিঙ্গাপুর পুলিশের তৎপরতা এবং চিকিৎসকদের চেষ্টা সত্ত্বেও এই প্রিয় শিল্পীকে ফেরানো গেল না। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর প্রয়াণের খবর ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে।
ভক্তদের হৃদয়ে শোকের ছায়া
অসম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা থেকে শুরু করে ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ভক্তরা এ খবর শুনে বাকরুদ্ধ। শুধু উত্তর-পূর্ব নয়, বাংলা এবং হিন্দি গানের জগতেও তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় সর্বত্র ভেসে উঠছে শোকবার্তা, কেউ লিখছেন “অসমের আত্মা হারালাম”, কেউ লিখছেন “আমাদের হৃদয়ের কণ্ঠ চিরতরে থেমে গেল।”
ভক্তদের কাছে জুবিন গর্গ (Zubeen Garg) শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক আবেগ, এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, এক সাংস্কৃতিক পরিচয়। তাঁর গান মানুষকে এক করেছে, অঞ্চলের সীমানা পেরিয়ে যুক্ত করেছে আবেগের সুতোয়।
বহুভাষার এক অনন্য শিল্পী
বাংলা, অসমিয়া, হিন্দি তো বটেই— জুবিন গেয়েছেন ৪০টিরও বেশি ভাষা ও উপভাষায়। প্রতিটি ভাষার গানেই তিনি নিজের আবেগ ঢেলে দিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠে শোনা যেত প্রেম, প্রতিবাদ, আনন্দ ও ব্যথা— সবকিছুর এক মিশ্রণ। হয়তো এই কারণেই তাঁর গান এত মানুষকে ছুঁতে পেরেছে।
অন্যদিকে বলিউডেও জুবিন গর্গ (Zubeen Garg) নিজের ছাপ রেখে গেছেন। “ইয়া আলি” গানটির মাধ্যমে তিনি সারা দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তবে তাঁর কাছে সবসময়ই সমান গুরুত্ব পেত আঞ্চলিক গান ও স্থানীয় সংস্কৃতি। তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি কোনো এক ভাষা বা অঞ্চলের মধ্যে।
এক আন্দোলনের নাম জুবিন
সঙ্গীতের মাধ্যমে একতা গড়ে তোলা তাঁর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। উত্তর-পূর্ব ভারতের সংস্কৃতি ও সঙ্গীতকে জাতীয় মঞ্চে তুলে ধরতে তিনি অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ভক্তদের কাছে তাই তিনি শুধু গায়ক বা সংগীত পরিচালক নন— এক আন্দোলনের প্রতীক। অসমের রাজপথ থেকে শুরু করে দেশের বড় কনসার্টে, সর্বত্র তাঁর কণ্ঠ ভেসে উঠেছে। তিনি দেখিয়েছেন, সঙ্গীত কেবল বিনোদন নয়, সঙ্গীত হতে পারে প্রতিবাদের ভাষা, সংস্কৃতির পরিচয়, মানুষের মনের জানালা।
তাঁর কণ্ঠের বিশেষত্ব
জুবিন গর্গ (Zubeen Garg)-এর কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত বৈচিত্র্য। একইসঙ্গে কোমল ও শক্তিশালী। কোনো গানেই তাঁর আবেগের কমতি ছিল না। তিনি যেভাবে আঞ্চলিক গানকে সহজভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, সেটাই তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। তাই তাঁর গান শোনার সময় মানুষ শুধু সুর নয়, অনুভব করেছে জীবনের গভীরতা।
অসম এবং ভারতের সাংস্কৃতিক ক্ষতি
জুবিনের মৃত্যু শুধু তাঁর পরিবার বা ঘনিষ্ঠদের ক্ষতি নয়। এটি একটি সাংস্কৃতিক ক্ষতি, যা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। অসমের প্রতিটি প্রান্তে তাঁর কণ্ঠ প্রতিদিন বাজত— উৎসব, মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এমনকি সাধারণ মানুষের জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তেও। এখন সেই কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল।
তবে শিল্পীরা কখনো পুরোপুরি চলে যান না। তাঁদের কাজ, তাঁদের সৃষ্টিই তাঁদের অমর করে রাখে। আজও যেমন ভূপেন হাজারিকার গান অসমের আকাশে বাজে, তেমনই জুবিন গর্গ (Zubeen Garg)-এর গানও আগামী প্রজন্মকে ছুঁয়ে যাবে।
শেষ কথা
একজন শিল্পীর মৃত্যুর পর শূন্যতা তৈরি হয়, কিন্তু সেই শূন্যতা পূরণ হয় তাঁর কাজের মাধ্যমে। জুবিন রেখে গেছেন হাজারো গান, অসংখ্য ভক্তের ভালোবাসা আর এক অটুট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর কণ্ঠ, তাঁর গান, তাঁর পরিচয় আমাদের মাঝেই বেঁচে থাকবে। অসমের আকাশে, উত্তর-পূর্বের পাহাড়ে, বাংলার মেলায় কিংবা বলিউডের মঞ্চে— সর্বত্র বাজবে তাঁর কণ্ঠস্বর। জুবিন গর্গ (Zubeen Garg) তাই শুধু একজন শিল্পী নন, তিনি চিরকালীন কণ্ঠস্বর।
Disclaimer
এই লেখাটি তথ্যভিত্তিক এবং শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন। এখানে প্রকাশিত সব মতামত লেখকের নিজস্ব। এটি কোনোভাবেই সরকারি বা সংশ্লিষ্ট পরিবারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নয়।
অবশ্যই দেখবেন: লিটার প্রতি ২ টাকা দাম কমাচ্ছে মাদার ডেয়ারি; দাম কমছে অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্যেরও! জানুন বিস্তারিত