বর্ষা পেরিয়ে শরৎকাল এলেও রাজ্যে এখনও থামছে না হঠাৎ বৃষ্টি। ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস করার পর রাত নামতেই কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে আকাশ। হঠাৎ করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামছে, সঙ্গে বজ্রপাত আর প্রবল দমকা হাওয়া। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, এর মূল কারণ হল এক অস্বাভাবিক আবহাওয়া পরিস্থিতি— স্কোয়াল ফ্রন্ট (Squall Front)। এই শব্দটি হয়তো অনেকের কাছে নতুন, কিন্তু এর প্রভাব ইতিমধ্যেই মানুষজন টের পাচ্ছেন। তাহলে আসুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক, স্কোয়াল ফ্রন্ট কী, কেন তৈরি হয়, এর ফলে কী ধরনের আবহাওয়া পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং রাজ্যের কোন কোন জেলায় জারি হয়েছে সতর্কতা।
স্কোয়াল ফ্রন্ট (Squall Front) কী?
আবহাওয়ার ভাষায় স্কোয়াল ফ্রন্ট বলতে বোঝানো হয় এমন এক বিশেষ আবহাওয়া পরিস্থিতিকে যেখানে পূর্ব দিকের আর্দ্র পূবালী হাওয়া এবং পশ্চিম দিকের শুষ্ক পশ্চিমা হাওয়া মুখোমুখি সংঘর্ষে নামে। এই সংঘর্ষের ফলে হঠাৎ করে তৈরি হয় বিশাল আকারের কিউমুলোনিম্বাস মেঘ, যা দেখতে একেবারে দানবীয়।
এই মেঘ তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগে না, কিন্তু তৈরি হলে মুহূর্তের মধ্যে আকাশ ঢেকে যায় ঘন কালো মেঘে। এরপর শুরু হয় প্রবল দমকা হাওয়ার সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। অনেক সময় বজ্রপাতও ঘটে। একে সাধারণ ভাষায় বলা যেতে পারে – ‘আকস্মিক ঝড়-বৃষ্টি পরিস্থিতি’।
কীভাবে তৈরি হয় স্কোয়াল ফ্রন্ট?
স্কোয়াল ফ্রন্ট তৈরির মূল কারণ হল বাতাসের গতিপথে হঠাৎ পরিবর্তন ও আর্দ্রতার আধিক্য।
- দিনে ভ্যাপসা গরমে বায়ুমণ্ডলের নিচের স্তরে প্রচুর জলীয় বাষ্প জমে থাকে।
- রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস নেমে আসে।
- এই দুই ভিন্ন প্রকৃতির বাতাস মুখোমুখি সংঘর্ষে নামলেই তৈরি হয় স্কোয়াল ফ্রন্ট।
- কয়েক মিনিটের মধ্যেই এর জেরে তৈরি হয় ঘন কালো মেঘ এবং শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি।
স্কোয়াল ফ্রন্টের ফলে কী ধরনের আবহাওয়া দেখা দেয়?
আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, স্কোয়াল ফ্রন্ট তৈরি হলে কয়েকটি বিশেষ পরিস্থিতি দেখা দেয়—
- হঠাৎ করে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়।
- প্রবল দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে।
- মুষলধারে বৃষ্টি হয়, অনেক সময় মেঘভাঙা বৃষ্টিও হতে পারে।
- বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমক দেখা দেয়।
- অনেক সময় ভৌগোলিক অবস্থার কারণে একাধিক জেলায় জল জমে স্বাভাবিক জীবনে বিঘ্ন ঘটে।
দক্ষিণবঙ্গে স্কোয়াল ফ্রন্টের প্রভাব
গত কয়েকদিন ধরে কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, দুই মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা-সহ একাধিক জেলায় স্কোয়াল ফ্রন্টের জেরে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। সোমবার রাতেই বজ্রবিদ্যুৎ সহ তুমুল বৃষ্টির কবলে পড়ে কলকাতা ও হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকা।
সতর্কতা জারি
- ২ সেপ্টেম্বর দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় কমলা সতর্কতা (Orange Alert) জারি করা হয়েছে।
- দক্ষিণ ২৪ পরগণা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।
- সমুদ্রে যাওয়ার ওপর ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ফলে মৎস্যজীবীদের নিরাপত্তার স্বার্থে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।
স্কোয়াল ফ্রন্ট ও নিম্নচাপের যোগসূত্র
আবহাওয়া দফতরের মতে, বঙ্গোপসাগরে নতুন করে নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে। এই নিম্নচাপ স্কোয়াল ফ্রন্টকে আরও শক্তিশালী করছে। ফলে আগামী কয়েকদিন দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে নদী-সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় জলস্তর বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শহরাঞ্চলে জল জমে যান চলাচলে সমস্যাও হতে পারে।
রাজ্যের সাধারণ মানুষের জন্য করণীয়
আবহাওয়া দফতরের সতর্কবার্তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সাবধান থাকতে হবে—
- বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গায় না থাকা ভালো।
- বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার এড়িয়ে চলা উচিত।
- অতি প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় বেরোবেন না।
- মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে না যাওয়ার পরামর্শ মানতে হবে।
- জল জমা এলাকায় সাবধানে চলাফেরা করতে হবে, কারণ বজ্রপাত বা শর্ট সার্কিটের ঝুঁকি থাকে।
স্কোয়াল ফ্রন্ট: কৃষি ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব
- কৃষি ক্ষেত্র: অতিবৃষ্টির কারণে মাঠে জমে থাকা ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। বিশেষত ধান ও সবজি চাষ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
- অর্থনীতি: শহরে জল জমে যান চলাচল ব্যাহত হলে অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যে সমস্যা দেখা দেয়।
- জলস্তর বৃদ্ধি: নদী-সমুদ্র অঞ্চলে জল বেড়ে গেলে চাষের জমি প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বর্ষা বিদায় নিলেও দক্ষিণবঙ্গে এখনো স্কোয়াল ফ্রন্টের কারণে হঠাৎ বৃষ্টির দাপট চলছে। একদিকে ভ্যাপসা গরমে মানুষ হাঁসফাঁস করছে, অন্যদিকে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টিতে সমস্যায় পড়ছেন সাধারণ মানুষ। আবহাওয়া দফতরের রিপোর্ট বলছে, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সক্রিয় থাকায় অন্তত আগামী কয়েকদিন বৃষ্টি থেকে মুক্তি নেই। তাই সচেতন থাকা, সরকারি নির্দেশ মেনে চলা এবং প্রয়োজনীয় সাবধানতা নেওয়াই এই পরিস্থিতি সামলানোর একমাত্র উপায়।
Squall Front Related সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন ১: স্কোয়াল ফ্রন্ট কী?
উত্তর: স্কোয়াল ফ্রন্ট হল এমন একটি আবহাওয়া পরিস্থিতি, যেখানে পূবালী ও পশ্চিমা বাতাসের সংঘর্ষে দানবীয় কিউমুলোনিম্বাস মেঘ তৈরি হয় এবং হঠাৎ করে ঝড়-বৃষ্টি নেমে আসে।
প্রশ্ন ২: স্কোয়াল ফ্রন্ট কবে বেশি হয়?
উত্তর: সাধারণত বর্ষা ও শরৎকালে, যখন বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে এবং গরমের কারণে জলীয় বাষ্প জমে থাকে, তখন স্কোয়াল ফ্রন্ট বেশি তৈরি হয়।
প্রশ্ন ৩: স্কোয়াল ফ্রন্টের সময়ে কোন জেলায় বেশি প্রভাব পড়ে?
উত্তর: কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, দুই মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলায় স্কোয়াল ফ্রন্টের প্রভাব বেশি দেখা যায়।
প্রশ্ন ৪: স্কোয়াল ফ্রন্টের সময় মানুষ কীভাবে সতর্ক থাকবে?
উত্তর: বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা এড়িয়ে চলা, বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার না করা, অতি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না বেরোনো এবং সরকারি সতর্কতা মেনে চলাই সবচেয়ে জরুরি।
প্রশ্ন ৫: স্কোয়াল ফ্রন্ট ও নিম্নচাপের মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: নিম্নচাপ হল বায়ুমণ্ডলের চাপ কমে যাওয়ার কারণে তৈরি আবহাওয়া পরিস্থিতি, যা দীর্ঘস্থায়ী বৃষ্টি আনতে পারে। স্কোয়াল ফ্রন্ট হল বাতাসের সংঘর্ষের ফলে তৈরি আকস্মিক ঝড়-বৃষ্টি পরিস্থিতি, যা স্বল্পস্থায়ী হলেও ভয়াবহ হতে পারে।
অবশ্যই দেখবেন: সোনার দাম চড়ছে হু হু করে! বছরের শেষে কত গুনতে হবে ১ ভরির জন্য?